আগামীকাল মাকেটিং পরীক্ষা, প্রশ্নের উত্তরগুলোও ঠিকমত গুছানো হয়নি তাই রিমনের কাছে নোট এর ব্যাপারে বলতে হল। কথাছিল ক্লাস শেষে এক সাথে বের হয়ে নোট ফটোকপি করে যে যার পথে পা বাড়াব, কিন্তু রিমন ভুলেই গিয়েছিলো নোটের কথা। যখন তুহিন ফোন দিলো তখন রিমন রায়সা বাজার মোড়ে, ভাগ্যিশ ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকিনি! পেট তখনও চোঁ চোঁ করছিল। তুহিনের আবার প্রইভেটের তাড়া, পা চালিয়ে রিমন কে ধরার জন্য হাটা শুরু করলাম, ওদিকে ওকে ফোন দিয়ে বাস থেকে নামতে বলেছি। আমি আর তুহিন দুজনেই হাটছি তবে গতি কারোরই বেশি না। আমি তুহিনকে তাড়াতাড়ি পা চালানো জন্যে বললে, ব্যাটা বলে কি-না, ‘এক কাজ করো তুমি আগে গিয়া রিমন আলীরে ধরো, আমি আস্তাছি !’ যা রাগ উঠল না বেটার উপর ! যাহোক দুজনেই কোট কাচারি পার হয়ে নাজমা ল হাউজ এর এখানে আসতে না আসতেই তুহিন টিপ্পুনি কাঁটল, ‘কি? তোমার বোরখাওয়ালী না এদিকে থাকে ! ’ আমি মুচকি হেসে সম্মতি জানাতে না জানাতেই রিমন উপস্থিত, ‘কিরে মামা! আমারে তো বাস থেকা নামায়ে ছাড়লি।’ তুহিন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে যোগ করল,‘বুচ্ছো মামা, হুজুরের লেগা মাইয়া খুঁজতাছি, পর্দা পুঁষিদা পুরা লাগবো,’ আমিও সাথে যোগ করলাম,‘মিয়া ছয় নম্বর না জানলে কিন্তু অব না!’ এভাবে তিনজন মিলে রাস্তা পার হয়ে একটা ফটোকপির দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, বোথ পেজ ফটোকপি কত? ব্যাটা বলে কি-না , দুই টাকা। আমরা একটু আগালেই যেহেতু ভার্সিটি, ওখান থেকে দেড়-টাকায় করতে পারি, তাই এ জায়গায় করলাম না। তারপর আবার, তিনজন ভার্সিটির পথে হাটা শুরু করলাম, এদিকে রিমন ভাই অত্যন্ত অনুযোগের সাথে বলছিল,- “তোরা মামা, শুধুশুধু আমারে নামালি! বইয়ে তো সবই ছিলো, একটু গুছাইয়া নিলেই অয়! (তবে আমি জানি তাকে বললেও এখন সে আর বাসে উঠবে না, আর অনুযোগটা ভাগিনেদের পক্ষ থেকে মেনে নেয়াটাই শ্রেয়।)” হাঁটতে হাঁটতে তুহিন আবার শুরু করলো, ‘জানো মামা ! হুজুর, বুড়া ঠাকুর এর গল্পগুচ্ছও শেষ করেছে, আবার রোমান্টিক উপন্যাসও পড়া শুরু করছে !!!’
এভাবে হাটতে হাটতে যখন আমরা জগন্নাথের মেইন গেটের ঠিক উলটো পাশটায় এসে পৌঁছেছি, ঠিক তখনই দেখলাম ছেলেপেলে লঠি-ঠেঙা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, কি বুঝলাম জানি না ! আমরাও কিছুটা দৌড়ালাম এবং একপর্যায়ে যখন দেখলাম তারা আমাদের পিছু নেয় নি, তখন তুহিন এর কথামতো ব্যাংকের গেটের পাশে এসে দাড়ালাম, এদিকে রিমন আক্ষেপের সুরে বলছিলো,‘তোরা আমারে বেজালে ফালায়া দিলিরে, মামা !’ আমারও ওর জন্য খারাপ লাগছিল, ব্যাপারটা উপকারীকে বাঘে খাওয়ার মতই, বেচারা উপকার করার জন্য বাস থেকে নেমে এতটুকু হেটে নিছক একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল, শেষে বাবা মুশকিল আছান(তুহিন) বলল, ‘আস্তে আস্তে আমরা রাস্তাটা পার হয়ে, ফটোকপির দোকানগুলোর ওদিকে যাই।’ তবে একটু আগে দৌড়ানি খাওয়াতে ব্যাপারটা ভালোমত বুঝতে পারিনি এখন দেখলাম ব্যাপারটা সামান্য নয়, অন্তত রাস্তায় ইট-পাটকেল এর ছড়াছড়ি থেকে তো তা মনে হচ্ছে না। উৎসুক জনতা আর দর্শক (যারা দোতালা-তিনতলা থেকে লাইভ দেখছেন) তাদের বাদ দিলেও যারা অংশগ্রহণ করছে তাদের চেহারা যথেষ্ট আক্রমণাতœক, এরই ফাঁকে আবার দইগ্রুপের দৌড়াদৌড়িও দেখলাম , এক পক্ষ অবস্থান নিয়েছে ভার্সিটির গেটের ভিতওে, অন্যপক্ষ রাস্তায়। এরপর অবস্থা কিছুটা থামলে তুহিনের কথামতো ভয়ে ভয়ে রাস্তার ওপারে গেলাম, আস্তে আস্তে বললে ভুলই হবে, অনেকটা দৌড় দিয়েই গেলাম। ওপারে গিয়ে তো চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা! কে কি ফটোকপি করবে? ঢালাও হারে সব দোকান বন্ধ। এদিকে, এদিক-সেদিক অনেকক্ষণ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে আর কিছুটা দৌড়ানি খেয়ে দেখলাম, ফটোকপি’র মার্কেটের বাইরে থেকে কে একজন যেন ভিতরকার লোকের সাথে কথা বলছে এই ভরসায় সেইস্থানে গিয়ে তুহিন বলল কিছু সীট ফটোকপি করে দিতে আর তার সাথে-সাথেই তালার শব্দ পেলাম, এরপর কিছুক্ষণ। কিন্তু আমার ধারনা রিমন ভাঙ্গল,‘মামা, তালা তো আরেকটা মারল!’ অমনি-
ঐ! ঐ!! ঐ!!!
আমরা যে-যেদিকে পারি দৌড়ালাম, দৌড়াতে-দৌড়াতে একটা গলিতে গিয়ে পৌঁছলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুহিন আবিস্কার করল আমরা বিপক্ষ দলের মধ্যে আছি অমনি তাড়াতাড়ি অবস্থান পরিবর্তন করলাম, আমার কেবল রিমনের জন্য আফসোস হচ্ছিল। গলি থেকে যেই বের হয়ে আইল্যান্ডের উপর দাড়িয়েছি তখন কয়েকজন পুলিশকে দেখলাম গন্ডগোল থামানোর জন্য লাঠিসোটা নিয়ে এগোলো, কিছুক্ষণ পরই আবার তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো! আমার মনে হয় একটু গর্বই হচ্ছিল, এই ভেবে যে, আমাদের ছেলেগুলোর কাছে পুলিশ ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে। হঠাৎ একজন বলে উঠল ‘হলের পোলাপানগুলাই গ্যাঞ্জাম করতাছে!’ আমি শুধরে দিলাম এদের তো হল নেই। নিজের এতটাই লজ্জা করছিল সে আমাদের হল নেই কথাটা যেন মুখ দিয়ে বের হলো না, একজন বয়োজেষ্ঠ্য বলে বসল,‘এক একটারে জমি বেইচা পড়া-লেখা করতে পাঠায়, আর এই অইল তার নমুনা!’ নিজেকে এতটাই ছোট লাগল যে, আমি আর নিজেকে বুঝাতে পারলাম না ‘সবাই তো আর এগুলো করে না’ বা ‘হাতের পাঁচ আঙ্গুল তো সমান হয় না’
ঐ! ঐ!! ঐ!!!
আঁচমকা মনে হলো মানুষ গুলো উঁপচে এসে শরীরে পড়লো ! অমনি প্রাণপনে ছুটলাম, মনে হচ্ছিল এই বুঝি পথে স্যান্ডাল খুলে যায়। এক্কেবারে ওভার ব্রিজটায় ওঠে দম নিলাম। নিচে দূরে দেখলাম তুহিন আর রিমন আমাকে খুঁজছে, ওদের কোনমতে ইশারায় বুঝালাম আমি উপরে, শেষে নিচে নেমে বুঝলাম আজকে আর কপালে ফটোকপি নেই। কিন্তু যেতে হলে গুলিস্থান ছাড়া উপায়ও নেই, তখন তুহিন আবার মন্তব্য করল যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝামেলা থেমে যাবে তাই ওর কথায় ভরসা করে আবার সেই আইল্যান্ডে গিয়ে দাড়ালাম। এবার কিন্তু একেবারে শেষ মাথায় ! যেন সহজেই দৌঁড়াতে পারি, এদিকে আইল্যান্ডের প্রথমদিকে ইশারা করে কে যেন বলল,‘অ ! হুজুররাও দেহি লগে আছে !!!’ আমি খেয়াল করে দেখলাম তুহিন রশিদ কে দেখিয়ে দিলো, যে আমাদেরই ক্লাসের-ই ছেলে। এছাড়াও আমি ওকে ভাল করে জানি যে, এত্তোবড় জনহিতকর কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয়। ফলে আমিও পাল্টা উত্তর দিয়ে বসলাম,‘হুজুররা লগে নাই, আমাগো মতোই পরিস্থিতির ¯^ীকার!’ সাথে তাল মিলাইনি বলে যে লোকটার মুখ কালো হয়ে গিয়েছিলো তা তার চেহারা না দেখেও বুঝতে পেরেছিলাম।
এদিকে বাঁম পাশে কিছুক্ষণ আগে ধাওয়া খেয়ে ভেগে যাওয়া পুলিশগুলোকে দেখলাম একটা গাড়ি করে ফটকের দিকে এগোবার চেষ্টা করছে, ব্যাপারটা আমার আছে খুব মজা মনে হলো, অনেকটা ছোটবেলায় চোর-পুলিশ খেলার মত। তাই মনোযোগ দিয়ে তাদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ দেখলাম, এবারেও তারা ছাত্রদের কাছে পৌঁছা তো দূরের কথা, লেজ গুঁটিয়ে পেছনে হটতে শুরু করল। এরই মাঝে রিমন এর একটি শব্দ কানে গেল, ‘মান-সন্মান আর কিছু থাকলো না!” আমি ঘাড়টা ঘোরাতে না ঘোরাতেই দেখলাম একজন বয়স্ক রিক্শাওয়ালা পেছনের দৌড়াদৌড়ী লক্ষ করে বারবার বলতেছে-
“পড়া লেহা করাইতাছে.....
প-অ ফ-অ ম-অ জ-অ ” !!!